কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধু পরিবারের বিরুদ্ধে করা কুৎসিত প্রচারণা। এ বিষয়ে আরও কঠোর নজরদারির পক্ষে সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশনা থাকলেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানগুলো পুরোপুরি সাফল্য দেখাতে পারছে না।
তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যে কোনো মূল্যে তাঁরা সব কিছু সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সরকারের মন্ত্রী পরিষদের বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্যসহ পুরো সরকার ও রাষ্ট্রকে নিয়ে বিভিন্ন অপপ্রচার চালানো হচ্ছে অনলাইন ও ডিজিটাল মাধ্যমে।
আর এক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ভিডিও স্ট্রিমিং সাইটগুলোকে ব্যবহার করা হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। এমন অপপ্রচার নিয়ন্ত্রণে আইনের প্রয়োগ এবং ডিজিটাল নজরদারী বাড়ানোর পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরেই সরকারকে বিব্রত করতে সরকারপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বেশ কয়েকজন মন্ত্রীকে নিয়ে অনলাইনে ছড়ানো হচ্ছে মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য।
গুজব আর অপপ্রচার থেকে রেহাই পাচ্ছেন না রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের মতো ব্যক্তিত্ব, যিনি সজ্জন ও সাদা মনের রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত। রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের ভেতরে ও বাইরে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতেই ‘টার্গেট’ করা হচ্ছে তাদের।
বিশেষ করে বহির্বিশ্বে সরকারের ‘ইমেজ’ নষ্ট করতে দেশের বাইরে থেকেই চালানো হচ্ছে এসব অপপ্রচারের বড় অংশ। সাইবার নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন অপরাধ নিয়ন্ত্রণে এবং অপরাধীদের নিরুৎসাহিত করতে আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে।
সেই সেঙ্গে বাড়াতে হবে ‘ডিজিটাল নজরদারী’। সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা বলেন, যারা এমন অপরাধ করছেন, তাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হলে অন্যরা নিরুৎসাহিত হবেন। যারা দেশের বাইরে থেকে এসব করেন তাদেরকেও দেশের প্রচলিত আইনেই দেশে এনে বিচার করার বিধান রয়েছে। আইসিটি অ্যাক্টের ৪ ধারায় এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও এমন বিধান রয়েছে।
একই সঙ্গে সাইবার জগতে ডিজিটাল নজরদারী বাড়াতে হবে। জোহা বলেন, বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যমে কে কী পোস্ট করছেন, প্রধানমন্ত্রী বা এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিয়ে কে কী মন্তব্য করছেন, পোস্ট করছেন এগুলোতে আরও বেশি নজরদারী আনতে হবে।
এর জন্য সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার সম্বলিত ‘ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স’ সেট আপ আনতে হবে। এ ধরনের অপরাধ তদারকিতে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ এবং বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) সহ সংশ্লিষ্ট আরও কিছু সংস্থা নিয়ে একটি মনিটরিং সেল রয়েছে। তবে তাদের কাছে এ ধরনের প্রাযুক্তিক সক্ষমতা নেই।
এগুলো পুলিশ ও প্রতিরক্ষা বাহিনীর কিছু ইউনিটে রয়েছে। তবে তারা নিজেদের মতো করে ‘টার্গেট’ নির্ধারণ করে কাজ করে। আমার পরামর্শ হলো, পুরো বিষয়টি যেন এই মনিটরিং সেল করতে পারে তার জন্য এটিকে আরও শক্তিশালী করা, যেন কেউ কোনো ডিজিটাল মাধ্যমের কোথাও একটি মন্তব্য বা পোস্ট করলেই সাথে সাথে তার সবরকম তথ্য যেমন- তার বয়স, লিঙ্গ, অবস্থান, পেশা ইত্যাদি সবকিছু যেন মনিটরিং সেলের কাছে চলে আসে।
অনেক সময় বিদেশে অবস্থানরত অপরাধীদের শনাক্ত করতে স্থানীয় প্রশাসনকে এসব তথ্য দিতে হয়, যেমন অপরাধীর ডিভাইসের আইপি অ্যাড্রেস, ম্যাক অ্যাড্রেস, আইএমইআই ইত্যাদি। তবে এমন মতামত থেকে কিছুটা ভিন্নমত পোষণ করেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার।
তিনি বলেন, যেসব সংস্থার কাছে ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স আছে তারা তো আমাদের কাছে প্রতিবেদন পাঠায়ই। আর আমরা সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নিই। এখন এ ধরনের সেটআপ নিয়ে এলে একই কাজ দুইবার করা হবে।
যখনই আমাদের কাছে এমন প্রতিবেদন আসে তখনই আমরা সংশ্লিষ্ট প্ল্যাটফর্মকে জানাই এবং সেগুলো সরিয়ে দেওয়া হয়। ফেসবুক, ইউটিবের মতো প্ল্যাটফর্ম এ ধরনের বিষয়ে সরকারকে কতটা সহযোগিতা করেন, এমন প্রশ্নের জবাবে মোস্তাফা জব্বার বলেন, ফেসবুক, ইউটিউব বা গুগল তারা তাদের নিজেদের ‘কমিউনিটি গাইডলাইন্স’ এর দোহাই দিয়ে আমাদের খুব একটা সাহায্য করতে চায় না। বড় জোর কনটেন্ট সরিয়ে ফেলে।
কিন্তু কারা এটা করলো, এর পেছনে আরও কারা কারা আছে এসব বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য বেশিরভাগ সময় আমাদের নিজস্ব ইন্টেলিজেন্স থেকেই সংগ্রহ করতে হয়। তবুও তারা এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি সাহায্য করে।
তবে সেটি কাঙ্খিত মাত্রায় নয়। অর্থাৎ আমরা যতটা আশা করছি ততোটা না। এদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম নিয়ন্ত্রণে সরকার কঠোর আইন প্রণয়নের কথা ভাবছে বলে জানান আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক।
গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় এমন বিষয় ছড়ানো হয়। পাশাপাশি নানা ধরনের গুজব ছড়ানো হয়। এসব অপরাধ ঠেকাতে নতুন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। প্রস্তাবিত আইনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রেখে দেশে সেসব যোগাযোগ মাধ্যমের অফিস স্থাপনেরও বিধান রাখা হবে। ইতোমধ্যে সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, তুরস্ক এ ধরনের আইন করেছে।
উন্নত বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে এই আইনের খসড়া চূড়ান্ত করা হবে। প্রস্তাবিত নতুন আইনে পুরো সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে আমরা কাজ করছি। আইনে ডেটা নিরাপত্তা ও ব্যক্তিগত তথ্য গোপনীয়তার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
একইসঙ্গে এমন অপপ্রচারমূলক কন্টেন্ট শেয়ার, লাইক বা কমেন্ট করা থেকে বিরত থেকে সচেতন হওয়ার আহবান জানান আইসিটি প্রতিমন্ত্রী। পলক বলেন, অন্য কেউ যদি এগুলো দেখে পোস্ট বা লাইক শেয়ার না করে, তাহলে কিন্তু এটা ছড়ায় না।
আমরা যদি তাদের কাজে সাড়া না দিই তাহলে দেখা যাবে একসময় রাষ্ট্র ও সরকারবিরোধী পোস্ট আর কেউ দেবে না এবং এ কাজ থেকে বিরত থাকবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালমা আক্তার বলেন, সামাজিক এই যোগাযোগমাধ্যম তৈরি করা হয়েছিল যাতে এর ব্যবহারকারীরা অর্থনৈতিক-সামাজিক উন্নয়ন ও বুদ্ধিভিত্তিক কোনো বিষয়ে গঠনমূলক বক্তব্য দিতে পারেন।
সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে আমি মনে করি, কুৎসা রটানোর জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহার করা উচিত নয়। এখানে ব্যবহারকারী চাইলেই প্রকৃত তথ্যনির্ভর তথ্য না দিয়ে একজন সম্পর্কে ভুল তথ্য দিতে পারেন।
যেখানে মূলধারার গণমাধ্যম একটি বিষয়ে গবেষণা করে প্রকৃত তথ্য তুলে ধরে সেখানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কোনো তথ্যনির্ভরতা নেই। এক্ষেত্রে কারা সামাজিক মাধ্যমে তথ্য দিচ্ছেন এবং এর বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কেও আমাদের নিশ্চিত হতে হবে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমাদের কিছু কোড অব কনডাক্ট থাকতে পারে। তবে কিছু ক্ষেত্রে সরকারের জন্য কোড অব কনডাক্ট দেওয়া সমস্যার। কারণ এটি সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই।
যে কোনো তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা গণমাধ্যম যাই হোক না কেন এটি খুব তথ্যবহুল হতে হবে। এক্ষেত্রে কুৎসা রটানোর সুযোগও কমে আসবে। এ ছাড়া সামাজিক মাধ্যমে তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে ভাষার ব্যবহার সম্পর্কেও ব্যবহারকারীকে সচেতন হতে হবে। ভাষাটি যেন শোভন হয় তা লক্ষ্য রাখতে হব।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।